রেজওয়ান হোসাইন
লেখক
অপু এখন দশম শ্রেণীতে পড়ে। সে ক্লাসের একমাত্র প্রখর মেধাবী ছাত্র। সরকারি কলেজের ফার্স্ট বয় বললে এক নামে সবাই চিনে নেয় এই অপুকে। ইতোমধ্যে অণুর এসএসসি টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়েছে। টেস্টে পেয়েছে ৪.৯৫। পিতা-মাতার অনেক আশা ছিল অপু এ+ পাবে, কারণ অষ্টম শ্রেণীতে সে এক মাত্র গোল্ডেন এ+ পেয়েছিল তার স্কুল থেকে।
অণু তারপর থেকে অনেক চিন্ত শুরু করলো। এ+ কি হবে এসএসসি পরীক্ষার সেন্টারে। অপু নিজেকে মোটেও সান্তনা দিতে পারছে না। শিক্ষকরা অনেক বুঝাতে লাগলেন যে, সেন্টার পরীক্ষায় এ+ হবে চেষ্টা করে যাও। মা-বাবাও অণুকে অনেক বুঝাতে লাগলেন। টেস্টে হয়নি তাই কী হয়েছে? সামনে হবে। পিতা-মাতার অনেক আদরের একমাত্র ছেলে ছিলো অপু। তাকে নিয়ে পিতা-মাতার অনেক বড় স্বপ্ন ছিলো- আমার ছেলেকে বিসিএস ক্যাডার বানাবো। তাই অপুর লেখাপড়ার জন্য হাজার হাজার টাকা তার পেছনে খরচ করতে শুরু করে দিলেন। পিতা-মাতা ও শিক্ষকদের কথা শুনে অনেক আনন্দ শুরু করলো অপু। এ+ পাওয়ার জন্য লেখাপড়ায় মন দিয়ে চেষ্টাও শুরু করে দিলো। কিন্তু এমন সময় তার পাশের বাড়ির এক বড় ভাই নাম তার ‘রাব্বি’ সে ফেসবুক সেলিব্রেটি। এলাকার সবাই তাকে ফেসবুক ম্যান বলেও ডাকে। রাব্বি অপুকে একটা ফেসবুক আইডি খুলে দিতে চাইলো। কিন্তু অপু রাজি হলো না। কারণ অপু ফেসবুকের ফ অক্ষরও বোঝে না। ফেসবুক জগৎ সম্পর্কে অপুর ন্যূনতম কোনো জ্ঞান নেই। রাব্বি কোনোভাবে তাকে উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে রাজি করলো। আব্বু আম্মুকে অনেক রিকুয়েস্ট করে অপু একটা অ্যান্ড্রয়েড ফোন কিনে নিলো এবং
রাব্বির মাধ্যমে একটা আইডি খুলে নিলো। একদিনেই ফেসবুকে আইডি খুলে রাব্বি প্রমোট করিয়ে তার বন্ধু সংখ্যা বাড়িয়ে দিলো এবং ফেসবুকে মেসেঞ্জার, চ্যাট, কমেন্ট, লাইক, ট্যাগ, ছবি আপলোড, স্ট্যাটাস সব কিছু ভালোভাবে বুঝিয়ে নেশা ধরিয়ে দিল অপুকে।
ও হ্যাঁ তার নতুন আইডির নাম দিল ‘ব্লগার অণু’ এই নামে সে হঠাৎ করেই অনেক পরিচিতি লাভ করলো ফেসবুকের ভার্চুয়াল জগতে, লেখালেখির মাধ্যমে অনেক সাড়া ফেলে দেয় অল্প দিনেই। সারাদিন মোবাইলে ব্যস্ত অপু।
মা জিজ্ঞাসা করলেন, অপু তুই সারাদিন মোবাইলে কী পড়িস? বই পড়িস না কেন? মোবাইলে আমি বই পড়ি। ওখানে সব পড়া আছে। আচ্ছা বাপ ভালো করে পড়িস। তোকে এ+ পেতে হবে। তোর বাপের মুখ উজ্জ্বল করতে হবে। সব আশা পূরণ করতে হবে।
আচ্ছা মা তুমি যাওতো। এখন ব্যস্ত আছি। শুধু বকে। বোঝে না কিছু না। আচ্ছা বাবা রাতে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়িস।
এসএসসি সেন্টার পরীক্ষার আর মাত্র ৪৫ দিন বাকি আছে সামনে। সেই তুলনায় অনেক কম সময় আছে তার হাতে। অপুর এ+ পেতে এখনো অনেক পড়া বাকি আছে। কিন্তু সে পড়াশুনার চেয়ে ফেসবুকে সময় দেয় বেশি। তার টার্গেট ফেসবুক জগতে সবার কাছে ফেমাস
হতে হবে। কিন্তু ‘ব্লগার অপু ফেসবুকে এত ফেমাস হয়ে গেল যে রাব্বির থেকে দ্বিগুণ লাইক কমেন্ট পেতে শুরু করলো। সারাদিন ফেসবুক নিয়েই মেতে থাকে। রাব্বিকে আর গোনার টাইম নেই অপুর হাতে। মাত্র ২৫ থেকে ৩০ দিনের ভিতরে ৪০০০ ফ্রেন্ড পূর্ণ হয়ে গেলো ‘ব্লগার অপু’ আইডিতে।
স্ট্যাটাস এর just now তে ১৫০ লাইক পেতে লাগলো। অপুর ফেসবুকিংয়ে অনেক হ্যাপি লাগছে। চ্যাটে প্রায় ৬০০-৭০০ ফ্রেন্ড অ্যাক্টিভ থাকে। সারাদিন রাত ফেসবুকে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে চ্যাটে মেতে ওঠে অপু। হাই হ্যালো এসএমএসের রিপাই দিতে দিতে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। কারণ, সে এখন ফেসবুকের বড় মাপের একজন ব্লগার ও লেখকও বটে। আইডিতে স্ট্যাটাস দিলে ২ হাজারের বেশি লাইক কমেন্ট পেতে শুরু করলো। অপুর হ্যাপিনেস ফেসবুকিং। মনের দিক থেকে অপু খুব খুশিতে দিন কাটাতে লাগলো।
অপু ডান হাতে ভাত খায়, আর বাম হাতে ফেসবুক চালায়। সারাদিন ফোন হাতে থাকে। যেখানে যায় ফোন হাতে নিয়েই যায়। এমনকি ল্যাটিনে যায় তাও ফোন নিয়ে যায়। বের হয় অনেক দেরিতে। বাথরুমের দরজায় কেউ নক না দিলে সে বের হতেই চায় না। মা বলেন, অপু তুই সারাদিন মোবাইলে কি গুঁতাগুঁতি করিস বাবা?
কিছুই না তো মা- অপু উত্তর দিলো।
পরীক্ষার আর মাত্র ১৫ দিন বাকি আছে। কিন্তু তার টার্গেট পরীক্ষার আগেই। সে ফেসবুকে
৫০০০ ফ্রেন্ড ফুল করবে।
৪৮০০ ফ্রেন্ড ফুল হলো। আর মাত্র পরীক্ষার ৫ দিন বাকি আছে। ভাবলো পরীক্ষার পর সে বাকি ২০০ ফ্রেন্ড বাড়াবে। কিন্তু অপুর বই পড়তে মন বসে না। বই সামনে মেলিয়ে সে বইয়ের ওপর ফোন রেখে ফেসবুক চাপাচাপি করে অনেক মজা পায়। ফেসবুকে বন্ধুদের কাউকে সে কেয়ার করে না। সে সেলিব্রেটি ফেসবুকে ২৫০০-২৮০০ লাইক পেতে শুরু করলো। আর দিনে দিনে দাম্ভিক হয়ে উঠলো।
আর মাত্র পরীক্ষার দুই দিন বাকি। আগামী পরশুদিন তার ফিজিক্স পরীক্ষা। কিন্তু লেখাপড়াই অনেক গ্যাপ হয়ে গেছে ফেসবুকে সময় দেয়ার কারণে। ভাবছে এবার একটু পড়ায় মন দিতে হবে।
অপু পড়ার টেবিলে বসলো। একটু করে পড়ে আর পোস্টে কত লাইক হলো সেটা দেখে। আর একটু পড়ে আর কোন বন্ধু sms দিছে কী লিখেছে সেটা দেখে। আবার দেখে চ্যাটে কত জন বন্ধু অ্যাক্টিভ আছে। এভাবে সে পড়াশুনায় উদাসীন হয়ে গেল।
আগামীকাল অপুর পরীক্ষা। আজ রাত ১১ পর্যন্ত বই পড়ে বাকি সময় ফেসবুক চালায়। কিন্তু ফেসবুক লগ আউট হয়ে যাচ্ছে বারবার অটোমেটিক। রাগ করে আর চালালো না রাত আড়াইটায় একটা পোস্ট দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে অপু। ইতোমধ্যে তার ৫০০০ ফ্রেন্ড পূর্ণ হয়ে ফ্রেন্ড লিস্ট পরিপূর্ণ হয়ে গেল।
পরীক্ষার দিন সকালে উঠে কিছুক্ষণ বই পড়ে তারপর ফেসবুক লগইন করে। রাতে একটা পোস্ট দিয়েছিল কত লাইক হয়েছে সেটা দেখার কৌতূহল শুরু হলো। ফেসবুকে লগইন করে ঢোকার চেষ্টা করেও পারছে না। কারণ খুব দ্রুত ফ্রেন্ড সংখ্যা বাড়ানোর দায়ে অ্যাকশন ব্লকে ‘ব্লগার অপু’ আইডি কে মার্ক জুকার বার্গ ডিজেবল করে দিয়েছে। “Your account has disabled”এই লেখা দেখে অপুর শরীর আগুন হয়ে গেল। তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। আকাশ ভেঙে তার মাথায় পড়লো। চারিদিকে অন্ধকার হয়ে এলো। দু’চোখ অশ্রুজলে ভিজে দুনিয়াটা ঝাপসা হয়ে গেলো। অপু তার বড় ভাই রাব্বিকে দেখালো, ঘটনা খুলে বললো। রাব্বি জানালো অতিরিক্ত ফ্রেন্ড দ্রুত বাড়ানোর কারণে আইডি action block খেয়ে ডিজেবল হয়ে নষ্ট হয়ে গেছে।
খানিকটা চুপ করে চোখের পানি ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে রাব্বির গলা ধরে কাঁদতে শুরু করলো অপু। আরেকটি আইডি খুলে দিবে বলে সান্ত্বনা দিল রাব্বি (অণুকে)। কিন্তু অপু নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারছে না এত জনপ্রিয় ‘ব্লগার অণু’ আইডি কিভাবে ডিজেবল হবে? এমন জনপ্রিয় আইডি কোথায় পাব?
আজ আবার অপুর পরীক্ষা, মন খারাপ করে না খেয়ে পরীক্ষা দিতে চলে গেল। প্রশ্নোত্তর কোন রকম করে দিয়ে বাড়ি চলে এলো।
মা জিজ্ঞাসা করলেন- কেমন হয়েছে অণু তোর পরীক্ষা? মন খারাপ কেন? কী হয়েছে তোর?
অপু বললো, কই কিছুই হয়নিতো মা। আমি পরীক্ষা দিয়ে টায়ার্ড হয়েছি তাই এমন লাগছে। ঠিক আছে বাবা ফ্রেশ হয়ে এসো দ্রুত খেতে হবে। আমরা তোর অপেক্ষায় বসে আছি না খেয়ে।
আমি এখন খাবো না ঘুমাবো।
এভাবে সে একে একে তার সব পরীক্ষা দিয়ে শেষ
করলো।
দুই মাস পরে-
অপুর রেজাল্ট বের হলো। অপুর বাবা মা খুব আনন্দিত ছেলের এ+ হবে। কিন্তু কোনোভাবেই অপুর রেজাল্ট দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ রেজাল্ট দেখতে পেল অপু। প্রথম দিনের সেই ফিজিক্স বিষয়ে ফেল। বিশ্বাস করতে পারছে না অপু! দুনিয়াটা অন্ধকার ঝাপসা হয়ে গেল তার চোখে।
অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো অপু। অপুর মা-বাবা সব বুঝতে পারলেন এবং প্রচুর কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন। কী হলো অপুর!! কিভাবে এমন হয়েছে?
জ্ঞান ফিরে অপু শুনলো তার বাবা হার্টফেল করে বিছানায় পড়ে আছে, তাকিয়ে দেখলো পাশে বসা মা হতভম্ব নির্বাক হয়ে গেছে। বাবা-মা খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিল এবং অপুর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলো। পিতা-মাতা শিক্ষক শিক্ষার্থী ও পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে মুখ দেখাতে না পেরে লজ্জায় বাড়ি ছেড়ে চলে গেল অপু।
একমাত্র আদরের ছেলেকে হারিয়ে পিতা-মাতা সর্বস্বান্ত ও পাগল হয়ে আছে সেদিন থেকে।
আজ ৫ মাস হয়ে গেল কিন্তু অপু ফিরে আসেনি। ভাত খাওয়ার সময় হলে পেটে ভাত বেড়ে অপেক্ষায় বসে থাকেন। পিতা-মাতা রাস্তা চেয়ে আছেন কখন আসবে ছেলে।