আফজাল এইচ খান
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি
রামাদান বা রমজান শব্দটা এসেছে আরবি মূল রামিদা বা আর রামাদ থেকে, যার মানে প্রচন্ড উত্তাপ কিংবা শুষ্কতা। ইসলামিক বর্ষপঞ্জিকা অনুসারে নবম মাস হলো এই রমজান মাস। এই মাসেই বিশ্বব্যাপী মুসলিমরা সিয়াম পালন করে থাকেন। রমজান মাসে সিয়াম পালন ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে তৃতীয়। অন্য মাসের তুলনায় এ মাসে ইবাদতের সওয়াব বহুগুণ। এই মাসেই নাজিল হয়েছিল পবিত্র কুরআন মাজিদ। কোরআন নাজিলের রাতকে বলা হয় লাইলাতুল কদর। এই রাতে ইবাদত করলে হাজার মাসের ইবাদতের থেকে বেশি সওয়াব পাওয়া যায়।
সাওম বা সিয়াম যার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে কোনো কাজ থেকে বিরত থাকা। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার এবং সেই সঙ্গে যাবতীয় ভোগ-বিলাস, পঞ্চইন্দ্রিয়ের দ্বারা গুনাহের কাজ এবং (স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে) যৌনসংগম থেকে বিরত থাকার নাম সিয়াম।
সিয়াম ফরজ হওয়ার সময়কাল:
সিয়াম একটি অন্যতম ফরজ ইবাদত। সিয়াম ফরজ হয়েছে হিজরি দ্বিতীয় সনে শাবান মাসে। অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর হিজরতের অষ্টাদশ মাসে কিবলা পরিবর্তনের পর সিয়াম ফরজ হওয়ার বিধান অবতীর্ণ হয়।
সিয়ামের ইতিহাস দীর্ঘতর:
সিয়াম পালনের মূল উদেশ্য হলো তাকওয়া অর্জন করা। আর তাকওয়ার বৈশিষ্ট সর্বযুগের সর্বকালের ঈমানদার-মুসলমানদের জন্য প্রযোজ্য বিষয়। সে কারণেই সিয়াম সকল নবী ও রসূলদের যুগে একটা গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। আল্লাহ তা’আলা মুসলিম উম্মাহর জন্য পবিত্র রমজান জুড়ে সিয়াম সাধনা তথা রোজাকে ফরজ করেছেন। অনেক নবি-রাসুলের ওপর তা ছিল ফরজ।
সিয়াম পালনে আলাহর নির্দেশ:
কুরআনুল কারিমে যে আয়াত দ্বারা উম্মাতে মুহাম্মাদির জন্য সিয়াম ফরজ করা হয়েছে, সে আয়াতেই আল্লাহ তা’আলা পূর্ববর্তীদের ওপর সিয়াম ফরজ হওয়ার বিষয়টি জানিয়ে দেন। এই আয়াতে সিয়ামের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে আল্লাহপাক সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা প্রদান করেছেন। ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর সিয়াম বা রোজা ফরজ করা হয়েছে। যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। যাতে তোমরা তাকওয়া (আত্মশুদ্ধি) অর্জন করতে পার। (সুরা বাকারা: আয়াত ১৮৩)
আলোচ্য আয়াত থেকে জানা যায় যে, আল্লাহ তা’আলা সব যুগের নবি-রাসুলদের জন্য সিয়াম পালনকে আবশ্যক করে দিয়েছিলেন। এর দ্বারা হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হজরত ঈসা (আ.) পর্যন্ত সব উম্মাত ও শরিয়তকেই বোঝানো হয়েছে। এতে বোঝা যায়, নামাজের ইবাদত থেকে যেমন কোনো উম্মত বা শরিয়ত বাদ হিল না, তেমনি সিয়াম ও সবার জন্য ফরজ ছিল। অর্থাৎ সব নবীর শরিয়তে রোজা পালনের বাধ্যবাধকতা ছিল নামাজের মতোই। ইসলামের আগে নবি-রাসুলদের সিয়াম পালনের কিছু
তথ্য তুলে ধরা হলো-
হজরত আদম আলাইহিস সালামের সিয়াম :
হজরত আদম (আ.)-এর ওপর প্রত্যেক মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ সিয়াম ফরজ ছিল। ফাতহুল বারিতে এসেছে, ‘হজরত আদম আলাইহিস সাল্লাম যখন আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে জান্নাতের ফল খেয়েছিলেন তখন তিনি ৩০ দিন পর্যন্ত তাওবা করেছিলেন। ৩০ দিন পর আল্লাহ তা’আলা তাওবা কবুল করেন। তারপর থেকে তাঁর সন্তানদের জন্য ৩০টি সিয়াম ফরজ করে দেয়া হয়।
হজরত নূহ আলাইহিস সালামের সিয়াম:
দুনিয়ার প্রথম রাসুল ছিলেন হজরত নূহ আলাইহিস সালাম। সে সময়ও সিয়ামের প্রচলন ছিল, হজরত নূহ (আ.) সর্বদা সিয়ানরত ছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সালাম বলেন, ‘হজরত নূহ আলাইহিস সালাম শাওয়াল মাসের ১ তারিখ এবং জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখ ছাড়া সারা বছর সিয়াম পালন করতেন।’ (ইবনে মাজাহ)
হজরত ইবরাহিম আলাহিস সালাম ও পরবর্তী যুগের রোজা।
হজরত নূহ আলাইহিস সালামের পর সর্বাধিক পরিচিত নবি ছিলেন হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম। আল্লাহ তা’আলা তাকে খলিল তথা বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, তাঁর যুগেও ৩০টি সিয়াম রাখা আবশ্যক ছিল। তাঁর পরের যুগকে বলা হতো বৈদিক যুগ। সে ধারাবাহিকতায় বেদের অনুসারী ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যেও ব্রত তথা উপবাস প্রথা চালু ছিল। ভারা প্রত্যেক হিন্দি মাসের ১১ তারিখে ব্রাহ্মণদের ওপর একাদশী’র উপবাস করতো।
হজরত মুসা আলাইহিস সালামের সিয়াম:
আল্লাহ তা’আলা হজরত মুসা আলাইহিস সালামকে আসমানি কিতাব ‘তাওরাত’ নাজিল করার আগে ৪০ দিন সিয়াম পালনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। হজরত মুসা আলাইহিস সালাম তুর পাহাড়ে সিয়াম পালনে ক্ষুধা ও পিপাসায় ৪০ দিন অতিবাহিত করেছিলেন। সে হিসেবে মুসা আলাইহিস সালামের অনুসারীরা ৪০ দিন পর্যন্ত সিয়াম পালনকে উত্তম বলে বিবেচনা করতেন। ৪০তম দিনে সিয়াম পালনকে তারা ফরজ তথা আবশ্যক মনে করতো। আর তা ছিল তাদের সপ্তম মাসের (তাশরিন) দশম তারিখ। এ দশম দিন ছিল তাদের কাছে আশুরা। এ আশুরার দিনে আল্লাহ তা’আলা হজরত মুসা আলাইহিস সালামকে ১০ আহকাম দান করেছিলেন। আর এ কারণেই তাওরাতে। ইহুদিদের ওপর প্রতি শনিবার বছরের মধ্যে মহররমের ১০ তারিখে আশুরার দিন সিয়াম ফরজ ছিল। এছাড়াও ইয়াহুদিদের অন্যান্য ছহিফাগুলোতেও অন্যান্য দিনে রোজা পালনের হুকুম পাওয়া যায়।
হজরত দাউদ আলাইহিস সালামের সিয়াম:
হজরত মুসা আলাইহিস সালামের পর আসমানি কিতাবের অধিকারী ছিলেন হজরত দাউদ আলাইহিস সালাম। তাঁর যুগেও ছিল সিয়ামের প্রচলন। তিনি একদিন পর একদিন সিয়াম রাখতেন। (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত) সে হিসেবে তিনি বছরের অর্ধেক সময় সিয়াম রেখে অতিবাহিত করতেন।
হজরত ঈসা আলাইহিস সালামে সিয়াম:
নিজেকে আসমানি কিতাবের ধারক হিসেবে তৈরি করতে হজরত ঈসা আলাইহিস সালাম কিতাব আসার আগে দীর্ঘ ৪০ দিন পর্যন্ত সিয়াম রেখেছিলেন। ৪০ দিন সিয়াম পালনের পর আল্লাহ তা’আলা হজরত ঈসা আলাইহিস সালামকে আসমানি গ্রন্থ ইঞ্জিল দান করেন। আর খ্রিস্টান ধর্মে এখনও সিয়াম পালনের প্রভাব বিদ্যমান রয়েছে।
হজরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালামের সিয়াম:
হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের সমসাময়িক নবি ছিলেন হজরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম। তিনি নিজে সিয়াম রাখতেন এবং তার অনুসারীগণের মধ্যেও সিয়াম রাখার রীতি বিদ্যমান ছিল।
নিয়ামের গুরুত্ব সম্পর্কে হজরত ঈসা (আঃ) এর বর্ণনা:
হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের কাছে তার অনুসারীরা জিজ্ঞাসা করতো যে, আমরা আমাদের অপবিত্র অন্তরসমূহকে পূতপবিত্র করতে কী করতে পারি? বা কিভাবে অন্তরসমূহকে অপবিত্রতা থেকে পবিত্র করতে সক্ষম হবো। হজরত ঈসা আলাইহিস সালাম তাদেরকে বলেছিলেন, ‘অন্তরসমূহের কলুষতা ও অপবিত্রতাকে পবিত্র রাখতে সিয়াম এবং দোয়ার বিকল্প নেই। অন্তর পবিত্র করতে সিয়াম পালনের নসিহত করেছিলেন।
প্রিয়নবির ঘোষণায় রোজার গুরুত্ব:
সিয়াম পালনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরে প্রিয়নবি সালল্লালাহু আলাইহি ওয়া সালাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি সিয়াম পালন করেও মিথ্যা কথা বলা, পরনিন্দা ও অন্যান্য পাপাচার থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারলো না। তার পানাহার পরিত্যাগ করায় আলাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (বুখারি) এ কারণে পূর্ববর্তী যুগের সব নবী-রাসূলদের সময়ও এ কথার ঘোষণা ছিল যে, তোমরা যখন সিয়াম রাখবে তখন লোক দেখানো মনোবৃত্তি নিয়ে মানুষের মত নিজেদের মুখমন্ডলকে উদাস করে রাখবে না। কেননা, এই শ্রেণীর মানুষ নিজেদের মুখমন্ডলের আসল রূপ বিকৃত করে রোজাদার রোজাদার ভাব গ্রহণ করতো। যাতে মানুষ মনে করে যে তারা রোজাদার। প্রাক ইসলামি যুগে আরববাসীরাও সিয়াম সম্পর্কে ওয়াকিফ হাল ছিল এবং তা পালনে সক্রিয় ছিল। মক্কার কুরাইশরা জাহেলিয়াতের যুগে ১০ মহররম সিয়াম রাখতো। এ দিনে পবিত্র কাবায় নতুন কিসওয়া বা গিলাফ পরিধান করানো হতো। (মুসনাদে আহমদ)
প্রাক ইসলামি যুগে মদিনার ইয়াহুদিরা ও পৃথক পৃথকভাবে আশুরার উৎসব ও সিয়াম পালন করতো (বুখারি)। তাদের সিয়াম পালনের দিনক্ষণ ছিল তাদের নিজেদের গণনার সপ্তম মাসের ১০ম দিন। প্রিয়নবি মদিনায় হিজরতের পরও ইয়াহুদিরা সিয়াম পালন করতেন। যা দেখে প্রিয় নবি সালল্লালাহ আলাইহি ওয়া সালাম বলেছিলেন, তোমাদের চেয়ে আমরাই এ সিয়াম পালনের হকদার বেশি।
সুতরাং মুমিন মুসলমানের আধ্যায় তাকওয়ার বীজ বপনে সিয়ামের বিকল্প নেই। সিয়াম মানুষকে মুত্তাকি হতে প্রস্তুত করে। আল্লাহর ভয় অর্জন করে পরিশুদ্ধ জীবন গঠনের অন্যতম প্রশিক্ষণও এ সিয়াম পালন। যেভাবে যুগে মুখে সব নবী-রাসূল সিয়াম পালনের মাধ্যমে নিজেদেরকে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হিসেবে তৈরি করেছিলেন। এ কারণেই আল্লাহ তা’আলা রোজার বিধানে আগের লোকদের ওপর সিয়াম ফরজের কথা উল্লেখ করেছেন এবং তাকওয়ার অধিকারী হওয়ার বিষয়টিও তুলে ধরেছেন। আলাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে রমজান মাসের সিয়াম পালনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে আত্মশুদ্ধি অর্জন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।