রমাদানের শিক্ষা

নুসরাত জাহান বন্যা

শিক্ষার্থী, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

মহান আল্লাহ যে তাঁর সৃষ্টিকুলের প্রতি বড়ই মহানুভব তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো রমাদান। ববের পক্ষ থেকে রমাদান নিয়ে আসে মাগফেরাতের অনন্য সুযোগ। এই বরকত পূর্ণ মাসে আল্লাহ তাঁর অসংখ্য পাপী বান্দাকে রহমতের ধারায় সিক্ত করে সুযোগ করে দেন তাঁর নৈকট্যভাজনদের অন্তর্ভূক্ত হওয়ার।
রমাদানে সিয়াম সাধনা বস্তুত মানুষকে আলোকিত ও আদর্শ চরিত্রবান রুপে গড়ে তোলার এক দীর্ঘ মেয়াদী প্রশিক্ষণ। এর উদ্দেশ্য হলো- প্রকৃত তাকওয়া অর্জন, আত্মসংযম, আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন। পবিত্র কুরআনুল কারীমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরয করে দেয়া হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী নবীদের অনুসারীদের ওপর ফরয করা হয়েছিল। এ থেকে আশা করা যায়, তোমাদের মধ্যে তাকওয়ার গুণাবলী সৃষ্টি হয়ে যাবে”। (সূরা
আল-বাক্বারাহ: ১৮৩)
তাকওয়ার প্রকৃত অর্থ হলো- সর্বাবস্থায় সকল প্রকার অন্যায় কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। মানুষের মধ্যে সহজাত পাপ প্রবনতা রয়েছে, বোযা মানুষকে এ পাপ প্রবনতা থেকে বিরত থাকতে শেখায়। একজন সত্যিকার রোযাদার বেহুদা কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যদি কেউ মিথ্যা কথা, পাপকর্ম ও জাহেলী আচরণ থেকে বিরত না হয় তবে তার পানাহার বর্জনে অর্থাৎ উপবাস থাকার আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই”।
আল্লাহ তা’য়ালা কেবল সে বোযাকেই গ্রহণ করবেন যার বুনিয়াদ হবে অন্যায় ও পাপ বর্জন। অর্থাৎ একজন রোযাদার যেমন তার পেটকে পানাহার থেকে বিরত রাখবে তেমনি সে তার মনকে খারাপ চিন্তা থেকে চোখকে অবৈধ কিছু দেখা থেকে তার কানকে গীবত, মিথ্যা ও অপ্রয়োজনীয় কথা শ্রবণ করা থেকে, তার মুখকে মিথ্যা ও বেহুদা কথা বলা থেকে এবং তার দেহকে শরীয়াহ বিরোধী কাজ থেকে বিরত রাখবে। বস্তুত সিয়াম সাধনা হলো নফসের কামনা-বাসনাকে সংযত ও নিয়ন্ত্রনে রাখার সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবস্থা।
সমস্ত ইবাদাতের মধ্যে নোযার একটি বিশেষত্ব রয়েছে। আর তা হচ্ছে অন্য সকল ইবাদাতের মধ্যে কিছু না কিছু বিয়া বা লৌকিকতার অবকাশ থাকে। কিন্তু রোযা ইবাদাত, যেখানে আল্লাহ ব্যাতীত আর কারো কোনো অংশ নেই। একারণেই হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “বান্দা একমাত্র আমার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই রোযা রেখেছে এবং আর প্রতিদান আমি নিজ হাতে দেবো”। রমাদান মাস পাপ থেকে ক্ষমা লাভের মাস। যে ব্যক্তি রমজান মাস পেয়েও তার পাপ সমূহ ক্ষমা করানো থেকে বঞ্চিত হলো আল্লাহর রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ধিক্কার দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “ঐ ব্যক্তিত্ব নাক ধুলায় ধূসরিত হোক যার কাছে রমজান মাস এসে চলে গেল অথচ তার পাপগুলো ক্ষমা করা হয়নি”। (তিরমিজি)
সত্যিই সে প্রকৃত পক্ষে সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত যে এ মাসেও আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেল। পবিত্র মাহে রমাদানের সিয়াম সাধনার মধ্যে আত্মশুদ্ধির পাশাপাশি মানবিক ও সামাজিক দিকও রয়েছে। মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সহানুভূতি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে রমাদান মাসের বোযার গুরুত্ব অপরিসীম। হাদীসে মাহে রমাদানকে ‘শাহরুল মুওয়াসাত’
(পারষ্পরিক সহানুভূতি প্রকাশের মাস) বলা হয়েছে। প্রতিটি রোযাদার মু’মিন বান্দাহ রমাদান, মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে গরীব-দুঃখী লোকেরা যে কত কষ্ট অনুভব করে, তার বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করে, তাদের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত হয় এবং দরিদ্র পীড়িত অগণিত আদম সন্তানের অনাহার ক্লিষ্ট মুখ তার অন্তরে সহানুভূতির উদ্রেক করে। সমাজের ধনী-সামর্থ্যবান মোযাদার ব্যাক্তি রোযা পালনের সাথে গরীব, দুঃখী, দুস্থ, অভাবী, অনাথ, ইয়াতিম, মিসকীন এবং কপর্দকহীন ব্যক্তিকে প্রয়োজনে অর্থ বণ্টন করে দেবে। এটা মাহে রমাদানে সহানুভুতি প্রদর্শনের সুবর্ণ সুযোগ। রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি একজন মোযাদারকে ইফতার করাবে, সে সমপরিমাণ সাওয়াব লাভ করবে এবং ওই নোযাদারের সাওয়াব বিন্দুমাত্র কমানো হবে না”।
মাসূলুল্লাহ সালালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মাতের বাস্তব শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে রমাদান মাসে দান-সাদাকা ও বদান্যতার হাত বেশি করে প্রসারিত করতেন এবং এ মাসটিকে তিনি দানশীলতার ব্যাপারে বিশেষ প্রশিক্ষণের মাস হিসেবে গ্রহণ করেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্নিত, তিনি বলেন, ‘রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমগ্র মানবজাতির মধ্যে সবচেয়ে উদার ও দানশীল ছিলেন। রমাদান মাসে তাঁর দান ও বাদান্যতা এতোই বেড়ে যেতো যে, তখন তাঁর দানশীলতা প্রবল বেগে বহমান বাতাসকেও হার মানাতো”। (বুখারী)
রমাদান হচ্ছে মুমিনদের জন্য ইবাদাতের বসন্তকাল। কিয়ামুল লাইল, কুরআন তিলাওয়াত, দান-সাদাকা, এ’তেকাফ, অধিক পরিমাণে তাওবা ও নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর ক্ষমা ও মাগফিরাত লাভের রয়েছে অনন্য সুযোগ। তাছাড়া রমাদান মাসে সৎকর্মের প্রতিদান বহুগুনে বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়। রমাদানের শেষ দশকে রয়েছে লাইলাতুল কদরের রাত। যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে এ রাতে ঈমান তাকওয়ার সাথে ইবাদাত বন্দেগী করবে তাঁর অতীতের সব গুনাহ ক্ষমা মাফ করে দেয়া হবে। এ বাতের গুরুত্ব বুঝাতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা পবিত্র কুরআনে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা নাযিল করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আমি এ (কুরআন) নাযিল করেছি কদরের রাতে। তুমি কি জানো, কদরের রাত কি? কদরের রাত হাজার মাসের চাইতেও বেশী উত্তম। ফেরেশতারা ও রূহ এই রাতে তাদের রবের অনুমতিক্রমে প্রত্যেকটি হুকুম নিয়ে নাযিল হয়। এ রাতটি পুরোপুরি শান্তিময় ফজরের উদয় পর্যন্ত”। (৯৭ সুরাঃ আল-ক্বাদরঃ ১-৫) লাইলাতুল কদরে আমাদের করণীয় হলো মহান রবের নিকট বেশি বেশি দোয়া করা। উম্মুল মু’মিনিন হযরত আয়েশা (রাঃ) নবী করীম (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘লাইলাতুল কদরে আমি কি দোয়া করতে পারি? তিনি বললেন, বলবে- ‘হে আল্লাহ্! আপনি ক্ষমাশীল। ক্ষমাকে ভালোবাসেন, অতএব আমাকে ক্ষমা করুন”।
এইতো দেখতে দেখতে বছর ঘুরে আবারও চলে এসেছে মাহে রমাদান। এখনি সময় সকল পাপ পঙ্কিলতাকে ঝেরে ফেলে একটি বিশুদ্ধ হৃদয়েন অধিকারী হওয়ার। মহান রব আমাদের সকলকে মহিমান্বিত এ মাসের পরিপূর্ণ বারাকাহ লাভের তাওফীক দিন। আমিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *