মুহাম্মাদ ফখরুদ্দীন আকবরী
বিশিষ্ট লেখক ও আইনজীবী, গাজীপুর জজ কোর্ট
পৃথিবীতে মহান আল্লাহর অঢেল নিয়ামত উপেক্ষা করে ন্যায় ও সত্যের সাথে চরম দুশমনী করেছে যে কয়টি শব্দ তার মধ্যে Secularism অন্যতম। Secularism ইংরেজী শব্দ। এটি ল্যাটিন শব্দ Seculam থেকে এসেছে। যার অর্থ পার্থিব। ইউরোপ-আমেরিকায় সেক্যুলারিজম বলতে সকল কর্মের সমানাধিকার নয় বরং ধর্মহীনতাকেই বুঝায়। ফ্রেজ ভাষায় Secularism-কে বলা হয় Lacism যার অর্থ হলো ধর্মহীন মতবাদ। বাংলাতে সেক্যুলারিজম বলতে ধর্ম নিরপেক্ষ মতবাদকে বোঝায়। এখানে ‘নির’ প্রত্যয় যোগ করা হয়েছে যার অর্থ নেই। অর্থাৎ ধর্মের পক্ষে নেই। বাংলা একাডেমির অভিধানে অপেক্ষার অর্থ ভরসা বা নির্ভরতা। অর্থাৎ যে ব্যক্তির ধর্মের উপর নির্ভরতা বা বিশ্বাস নেই সেই কেবল ধর্ম নিরপেক্ষ। ধর্ম নিরপেক্ষতার মূল লক্ষ্য হচ্ছে সকল ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা। সেক্যুলারিজম এর সংজ্ঞায় র্যানডম হাউজ অব দ্যা ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ-এ বলা হচ্ছে- Secular “যা ধর্ম সম্পর্কিত নয় (Not pertaining nor connected with religion) এবং যা ধর্ম বিশ্বাসের অন্তর্গত নয় (Not belonging to a religious order)। আর ধর্ম নিরপেক্ষতার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে এটি একটি রাজনৈতিক বা সামাজিক দর্শন যা সকল ধর্ম বিশ্বাসকে নাকচ করে দেয় (Rejects all forms of religious faith)। দন্ডবিধির (১৮৬০ সনের ৪৫নং আইন) ৮৯ ধারায় উল্লেখিত মঙ্গল বা উপকার বলতে ইহলৌকিক উপকার বুঝায়, পারলৌকিক নহে। তাদের মতে ধর্ম আর রাজনীতি আলাদা এবং আইন কানুন মানুষই তৈরী করবে, আইনের সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। অথচ পবিত্র কুরআন বলে যে ‘আল্লাহ্-ই আইন দাতা’। রাসূল (সাঃ) এর সময় দারুল হরব মক্কায় এক নেতা “ধর্ম নিরপেক্ষ মতবাদ” প্রচার করত বিধায় তার নাম দেয়া হয়েছিল আবু জেহল বা অজ্ঞতার বাবা। তাইতো প্রাচীন বা মধ্য, কোন যুগেই ধর্ম ও নৈতিকতাকে রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা করা হয়নি এবং পার্থিব ক্ষমতা হিসেবে রাষ্ট্রধর্ম, নৈতিকতা, ঐশ্বরিক আইন বা প্রকৃতিক আইনের উচ্চতর ক্ষমতাগুলোর অধীন মনে করা হতো। আধুনিক যুগে সেক্যুলারিজম এর জনক হিসেবে ১৪৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ইটালির ফ্লোরেন্স শহরে জন্ম নেয়া নিকোলো ম্যাকিয়াভেলীকে মানা হয়। তিনি ছিলেন ইহুদি এবং জন্মের দিক দিয়ে জারজ (পিতা মাতার বিবাহ বহির্ভুত অবৈধ সন্তান)। ১৫১২ খ্রিষ্টাব্দে ফ্লোরেন্স প্রজাতন্ত্রের পতনের পর তিনি ক্ষমতা থেকে অপসারিত হয়ে খামার বাড়িতে বসবাস
করার সময় তাঁর বিখ্যাত (*কুখ্যাত) পুস্তক ‘ডিসকোর্স’ ও ‘দি প্রিন্স’ রচনা করেন। ডিসকোর্স বইয়ে তাঁর সামগ্রিক রাষ্ট্র দর্শনের পরিচয় ও দি প্রিন্স বইয়ে সরকার পরিচালনা সম্পর্কিত কতগুলো বাস্তব উপদেশমালা বর্ণিত হয়েছে। ম্যাকিয়াভেলীর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণ বস্তুবাদী এবং তিনি মানুষকে “অকৃতজ্ঞ, চঞ্চল, প্রতারক, কাপুরুষ ও লোভী” বলে আখ্যায়িত করেন। তাঁর মতে, মানুষ যদিও স্বভাবত স্বার্থপর ও লোভী তথাপি জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা লাভের জন্য সে সরকারের শাসন মেনে নিতে চায় এবং সরকারী শাসনের ব্যাপক কাঠামোর মধ্যে তার নিজস্ব জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করে তার ব্যক্তিগত লোভ ও স্বার্থকে চরিতার্থ করতে চায়। কারণ মানুষ তার পিতৃহন্তাকে সহজে ক্ষমা করতে পারলেও তার পৈত্রিক সম্পত্তি হরণকারীকে ক্ষমা করতে পারে না। এমতাবস্থায় ধর্ম বা নৈতিকতার কথা আদৌ চিন্তা না করে রাষ্ট্র তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য যা কিছু অনুকূল তাই করে যাবে। তাই শাসককে সব সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যে, নিষ্ঠুরতা, চাতুর্য বা প্রতারণা যেভাবেই হোক না কেন, মানুষের মনে তাকে ভীতির সঞ্চার করতে হবে। কারণ ভীতির বন্ধনকে মানুষ কোন সময় ছিন্ন করতে পারে না বিধায় একমাত্র ভীতি উদ্রেকের মাধ্যমে মানুষকে বশীভূত করা যায়, ভালবাসা বা অন্য কোন পদ্ধতির মাধ্যমে নয়। তার মতে, রাজাকে সিংহের মতো শক্তিশালী এবং শিয়ালের মতো ধূর্ত হতে হবে। ম্যাকিয়াভেলীর মতে, রাষ্ট্রই হচ্ছে সর্বোচ্চ ক্ষমতা এবং তার উপর কোন উচ্চতর ক্ষমতা থাকতে পারে না। সেই সাথে চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে রাষ্ট্র তার অস্তিত্ব, নিরাপত্তা ও সম্প্রসারণের জন্য যা কিছু অনুকূল তাই করতে পারে। এতে ধর্ম বা নৈতিকতা কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না। রাষ্ট্রকে সব সময় যে ধর্ম ও নৈতিকতার পথ ধরে চলতেই হবে এমন কোন কথা নেই। আধুনিক সেক্যুলারিজম এর জনক নিকোলো ম্যাকিয়াভেলী ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে পরলোক গমন করেন। প্রকৃতপক্ষে ধর্ম নিরপেক্ষবাদীরা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য ধর্মের ব্যবহার করলেও ইসলামের পক্ষে থাকা তাদের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। তেল আর পানি যেমন মিশে না ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ আর ইসলাম এক সাথে চলতে পারে না। আর কেউ যদি রাজনৈতিকভাবে ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ করেন কিন্তু ধর্ম-কর্ম পালন করেন তা হলে বলতে হবে তিনি বুঝে-শুনে ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ করছেন না, আর না হয় তারা সরলপনা মানুষের সাথে ধোঁকাবাজি
করছেন।