স্মৃতিপটে সেন্টমার্টিন

ভ্রমণ ইয়াছিন আরাফাত

শিক্ষার্থী
ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ

শীতের শান্ত নীল সাগর। ফসফরাসের সাদা ফেনায় মাখা ছোট ছোট ঢেউ। তারা মনের সুখে তৈরি করে নানান নকশায় ভরা নির্জন বালুচর। বালিয়াড়ির উপর ফুটে আছে সাগরলতার গায়ে জড়ানো বেগুনী, গোলাপী ফুল। শনশন বাতাসেরা বালু আর ফুলের পাপড়িদের ছুঁয়ে দিয়ে হারিয়ে যায় কোন সুদূরে সেই বাতাসের সাথে উড়ে চলে যেতে চায় আমাদের মন। যেনো একঝাঁক সাদা গাংচিল।

ছোট্ট দ্বীপ সেন্টমার্টিন। টেকনাফ থেকে জাহাজে রওনা দিলে সাগরের নীলে আর আকাশের সাদা মেঘে আমাদের যে কারো মন হারিয়ে যেতে বাধ্য। চারপাশে পানি আর পানি। ঢেউ আর মেঘ। গাংচিলেদের গান। সাগরের বুকের ভিতর মাত্র তিন বর্গ কিঃমিঃ আয়তনের এক নিরাপদ। আশ্রয়। দূর থেকে দেখা যায় সারি সারি নারকেল গাছেদের পাতায় আলোর ঝিলিমিলি। স্থানীয়দের কাছে এই দ্বীপের নাম “নারিকেল জিঞ্জিরা”। অসীম নীল সাগরের উপর বাংলাদেশের শেষ চিহ্ন।

সময় ৩রা জানুয়ারি, ২০২১ রাত-৯:০০টা

পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারুণ্যে উদ্বেলিত একটি টিম আমরা গাজীপুর থেকে রওনা হই বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের ছোট্ট আকর্ষণীয় ভ্রমণস্থান, প্রকৃতি যেথায় তার রূপ, রস, গন্ধ ঢেলে দিয়েছে, অপূর্ব সৌন্দর্যমন্ডিত স্থান সেন্টমার্টিন দ্বীপের উদ্দেশ্যে।

শীতের রাত। রাতের খাবার সেরে শীতের ছিমছাম প্রস্তুতি নিয়ে আমাদের বেরিয়ে পড়া। রাতের অন্ধকারের মধ্য দিয়ে শহর, নগরের বুক চিরে বাসটি ছুটে চলছে গন্তব্যের দিকে। আমাদের গন্তব্য কক্সবাজার হয়ে টেকনাফ। এরপর টেকনাফ থেকে জাহাজযোগে যেতে হবে আমাদের কাঙিক্ষত গন্তব্য সেন্টমার্টিন দ্বীপে। প্রথম বারের মত

সেন্টমার্টিন ভ্রমণ হওয়ায় উচ্ছ্বাস উদ্দীপনাটা সবারই একটু বেশি। গান, আড্ডা আর সেন্টমার্টিনের জানা অজানা ইতিহাস নিয়ে বাসের মধ্যে চলছে ব্যাপক গবেষণা, আড্ডা। এরিমধ্যে মধ্যরাত। তন্দ্রাচ্ছন্ন দু’চোখ। পুলকিত মন নিয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি দিলাম নতুন ভোর দেখার অপেক্ষায়।

শান্তস্নিগ্ধ ভোরের নীরবতা ভেঙে মসজিদের মিনারগুলো থেকে ভেসে আসছে পবিত্র সুর। মুয়াজ্জিন ডাকছে-হাইয়্যাল আল ফালাহ্… ততক্ষণে আমরা কক্সবাজার পৌঁছে গিয়েছি। যাত্রাবিরতি দিয়ে ফ্রেশ হয়ে ফজরের নামাজ আদায়ের পর আবারও রওনা হই আমরা। টেকনাফ তখনও ১:৩০/২:০০ ঘন্টার পথ।

ভোরের আলো ফুটেছে। কুয়াশার আড়ালেই বোধহয় সূর্য উকি দিচ্ছে। আমাদের বাস ছুটে চলছে সতর্কতার সহিত। কুয়াশা, পাহাড়ঘেঁষা সরু রাস্তা আর রাস্তার বাঁক অতিরিক্ত সতর্কতার কারণ।

কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যাওয়ার রাস্তাটা বেশ উপভোগ্য। কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ রোড তো অনিন্দ্য। একপাশে পাহাড় অন্যপাশে সমুদ্র। জীবন যেন এখানেই সুন্দর। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের মধ্যে ডুবে আমার আমিকে আবিষ্কার করলাম টেকনাফ চেকপোস্টে। মানে টেকনাফ পৌঁছে গিয়েছি ইতোমধ্যে। টেকনাফ নেমে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তাটা সেরে নিলাম সবাই। এরপর কয়েকমিনিট হেঁটেই পৌঁছুলাম জেটি ঘাটে। যেখান থেকে জাহাজ ছাড়বে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে। দূরত্ব ৯ কিলোমিটার। টিকেট কাটা হলো। ততক্ষণে জাহাজ জেটি ঘাটে। জাহাজ-কেয়ারি সিন্দাবাদ। জাহাজ ছাড়ার সময় ৯:৩০মিনিটে।

সিরিয়াল ধরলাম জাহাজে উঠার জন্য। জাহাজে উঠেই আসন গ্রহণ করে খানিকটা বাদেই বেরিয়ে আসলাম আউটডোরে। সবার চোখেমুখে উচ্ছ্বাসের আভা। জাহাজ ছাড়লো। নাফ নদীর এককোণ থেকে জাহাজ যাত্রা করলো। কিছুক্ষণ বাদেই সাগরের বুকে মিশবে নদী। চরম আগ্রহ উদ্দীপনা নিয়ে চোখ বুলাচ্ছি চারিপাশে। হঠাৎ নস্টালজিক হয়ে পড়লাম নাফ নদীর দিকে তাকিয়ে। মিয়ানমারে নির্মমভাবে মুসলিম নিধন চলাকালীন সময় এই নাফ নদীর বুকেই প্রাণ বাঁচাতে আরাকানের মুসলিমরা ঝাঁপ দেয়। কেউ কেউ প্রাণে বাঁচলেও, সলিল সমাধি হয়ে যায় কয়েক সহস্রাধিক মুসলিম আরাকানদের। আরও বেশি অবাক হই যখন দেখি এই মানুষগুলো প্রাণ বাঁচাতে প্রায় দুই কি.মি. প্রশন্তের এই নাফ নদী সাঁতরিয়ে শাহপরীর দ্বীপে আশ্রয় নেয়। আহ্। কতটা নির্মম পরিস্থিতি। কবে বন্ধ হবে এই ধর্মীয় বিদ্বেষ?

সম্বিত ফিরে পেয়ে আবারও প্রকৃতির ওপর ফোকাস করলাম। গুগল ম্যাপে আবিষ্কার করলাম নাফ নদীর ওপারে মিয়ানমারের মংডু শহর। মংডু শহর নিয়ে বিশেষ আকর্ষণের কারণ বিপ্রদাশ বড়ুয়ার লেখা ‘মংডুর পথে প্রবন্ধের কারণে। সম্ভবত অষ্টম শ্রেণিতে পড়েছিলাম। শহরের নামের সাথে পরিচয় থাকায় আনন্দ অনুভব করলাম।

এতক্ষণে জাহাজ সাগরের বুকে এসে মিশেছে। নীলাভ জলরাশি যেন বিশালতার হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আমাদের বরণ করে নেয়ার জন্য গাংচিলেদের দল অভ্যর্থনার সুরের মূর্ছনায় আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। সেন্টমার্টিন যাওয়ার পথে এই গাংচিলেরাই বোধহয় সবচেয়ে বিশ্বস্ত সফরসঙ্গী এবং ঐ মুহুর্তটাই সবচেয়ে সুন্দর।

সমুদ্রের বুকের সৌন্দর্য ও সীমান্তের ওপারের মিয়ানমারের পাহাড়গুলোর ওপর চোখ বুলাতে বুলাতে আমরা আমাদের কাঙিক্ষত গন্তব্যের খুব কাছাকাছি। এখানে পর্যটকদের উদ্দেশ্যে যে বিষয়টা উল্লেখ করা প্রয়োজন সেটা হলো-

পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়ে দেয়া নির্দেশনাগুলো সবাই যথাযথভাবে পালন করবেন। সমুদ্রে পলিথিন, প্লাষ্টিক জাতীয় কিছু ফেলবেন না। অতিথি পাখিদের চিপস্, চকলেট, বিস্কুট খাওয়াবেন না। এতে পাখিদের মৃত্যুঝুঁকির আশংকা থাকে।

আমাদের জাহাজ জেটি ঘাটে ভিড়লো। জাহাজ থেকে নেমে আগে থেকেই বুকিং করা হোটেলে গিয়ে ব্যাগ-ব্যাগেজ রেখে সবাই বেরিয়ে পড়লাম সমুদ্রতীরে। দুটি দলে ভাগ হয়ে খেললাম ফুটবল। অত:পর শুরু করলাম গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলা কাছিটান। কাছিটান খেলাটা সত্যিই বেশ উপভোগ্য ছিল। এবার ঘর্মাক্ত শরীরটাকে সমুদ্রের নীলজলরাশিতে ভিজিয়ে নেয়ার পালা। সবাই সমুদ্রে নেমে পড়লাম। আর এদিকে নিজেদেরকে ক্যামেরাবন্দী করতে গ্রুপ ফটোসেশানের পাশাপাশি ব্যক্তি প্রতিযোগিতা তো চলছেই। সমুদ্রস্নান শেষে সেন্টমার্টিনের মিষ্টি ডাবে চুমুক আপনার ক্লান্ত, শ্রান্ত শরীরকে নিমিষেই চাঙা করে তুলবে।

এরপর হোটেলে ফিরে গোসল সেরে যোহরের নামাজ আদায় করে দুপুরের খাবার গ্রহণ। লাঞ্চের পর খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে সবাই বেরিয়ে পড়লাম সমুদ্র দর্শনে। সেন্টমার্টিনের পশ্চিম তীরটাই বোধহয় সবচেয়ে দর্শকপ্রিয়। পশ্চিম তীরে কিছুসময় ঘুরে দৃষ্টি দিলাম ছেড়াদ্বীপের দিকে। দূরত্ব দক্ষিণ দিকে ৮ কি.মি.। অনেকে হেঁটেই যায়। কিন্তু আমরা সবাই ভাড়ায় সাইকেল নিলাম। সমুদ্রতীরে সম্মিলিত সাইকেল

রাইড আরও বেশি উপভোগ্য এবং বেশ সুন্দরও বটে। ছেঁড়াদ্বীপের কেয়াবন, প্রবাল পাথর, স্বচ্ছপানির ওপর সূর্যালোকের ঝিলিক মনকে উদ্বেলিত করে। সবাই প্রকৃতির এই সৌন্দর্যকে ক্যামেরাবন্দী করতে ব্যস্ত। ভ্রমণকে স্মৃতিপটে সংরক্ষিত রাখার জন্য কেউ কেউ নিচ্ছে প্রবাল পাথর; যদিও তা নিয়মবিরুদ্ধ। এরিমধ্যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। আযান হচ্ছে মাগরিবের। আমরা সেখানে উন্মুক্ত পরিবেশেই নামাজ আদায় করে নিলাম। সে কি এক নির্মল পরিবেশ। সন্ধ্যা নেমে এলে এই স্থানের

সৌন্দর্য যেন বহুগুণে বেড়ে যায়। চাঁদনী পসরা রাত। সমুদ্র যেন নতুন রূপে আবির্ভূত হলো। ফিরে এলাম ছেঁড়াদ্বীপ থেকে। সেন্টমার্টিনের পশ্চিম তীরে এসে বিশ্রামের ভঙ্গিতে সীটে গা এলিয়ে দিয়ে সমুদ্র অবলোকন। পাশেই সামুদ্রিক সুস্বাদু মাছের বার-বি-কিউ। একটু চেখে না দেখলে যে এই ভ্রমণটাই বৃথা। আহা! সে কি স্বাদ! জোয়ারের পানি বাড়তে থাকলে হোটেলে ফিরে আসি। হোটেলের সামনে উন্মুক্ত জায়গায় বসে সবাই মিলে আড্ডা জমালাম বেশ। লুকায়িত প্রতিভাকে বিকশিত করার অপার সুযোগ। গান, আড্ডায় কেটে যায় অনেকটা সময়। মধ্যরাতের আরও পরে বিছানায় ফেরা। পরদিন খুব ভোরে উঠেই শেষ মুহুর্তের জন্য ছোট্ট জনপদ

সেন্টমার্টিনকে পুরোটা এক নজর ঘুরে দেখার জন্য আবার বেরিয়ে

পড়লাম। ফিরতে হবে দুপুরের মধ্যে। আতিথেয়তা ও খাতিরে

সেখানকার বাসিন্দাদের প্রশংসা করাই যায়।

এবার নীড়ে ফেরার পালা!

ফিরতি জাহাজ দুপুর ২:৩০টায়। সবাই সবকিছু গুছিয়ে জাহাজে ফিরলাম। ফিরতি পথে পুনরায় সমুদ্র ও প্রকৃতির ওপর দৃষ্টি বুলালাম। সমুদ্র পথ পাড়ি দিয়ে টেকনাফ এসে ভুলপথে ফাইনালি বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা। বাসের সীটে গা এলিয়ে দিয়েই এক মুহুর্তের জন্য ভাবনার জগতে হারিয়ে গেলাম।

ভাবছি- সাগর জলে গোড়ালি ডুবিয়ে প্রিয় মানুষদের সাথে দাঁড়িয়ে দেখা ভোর, ডাবের মিষ্টি পানি, তরতাজা মাছেদের স্বাদ, আর মিহি ঠান্ডা কুয়াশা ভেজা বাতাসের ডাক না শুনে, পূর্ণিমাসিক্ত রাতের সমুদ্র না দেখে শহরের এই ইট কাঠের দেয়াল বা কাঁচ ঘেরা রুমের ভিতর মানুষ কিভাবে আটকে থাকতে পারে? কিভাবে থামিয়ে রাখে জীবনের উৎসব?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *